সপ্তাহের সাতকাহন - সৈকতে হাবুডুবু

সপ্তাহের সাতকাহন:

 

       জীবনে অনেক হাবুডুবু খাইয়াছি।এখনও তো প্রতিদিন হাবুডুবুই খাইতেছি ।আর হাবুডুবু খাইতে খাইতে গাটেঁর পয়সা খরচ করিয়া হাবুডুবু দেখিতে সাগরতটে গিয়াছিলাম। সেইখানে যাহা দেখিলাম তাহাতে মনে পড়িয়া গেল কবিতার লাইন – “অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া জানে না সন্তরণ”। কিন্তু তৎক্ষণাৎ তাহা ভুল মনে হইল । কে বলিল জাতি ডুবিছে মরিয়া ? যেইভাবে হেলিয়া-দুলিয়া সেলফিতে পোজ দিয়া সাগরের লহরীতে নিজেদেরকে ভাসাইয়া দিতেছে, তাহা দেখিয়া জাতির ডুবিয়া মরিবার কোন লক্ষণ খুঁজিয়া পাই নাই। বরং যাহা দেখিলাম তাহাতে নিজেই আরো উজ্জিবিত হইয়া পড়িলাম । ছোটবেলায় মায়ের সহিত প্রথম সম্মিলিত স্নান করিবার নিমিত্ত বাঁশবাজারে বটগাছের পাশে গোমতীর জলে নামিয়াছিলাম। হাঁটুজলের নদীতে তখন আবালবৃদ্ধ সবাই নাইতে ব্যস্ত । কেউবা খালি গায়ে ভুরি ভাসাইয়া, কেউ মুখে বিরবির করিয়া নাভিতে তৈলমর্দন করিতে করিতে, আবার কেহবা নিজের দুই কানে ঘসিয়া ঘসিয়া ঝুপুৎ-ঝপাৎ হাবুডুবু খাইতেছেন । তাহা দেখিয়ে সেই কঁচিবেলায় বেশ পুলকিত হইয়াছিলাম। মা তখন বলিয়াছিলেন–বসন্তকালে অষ্টমীর প্রত্যূষে নদীতে সিনান করিলে অতীব পূণ্য হয়।সেই অষ্টমীর পূণ্যস্নানের পর বারেবারেই নদীতে একটু হাবুডুবু খাইতে ইচ্ছা জাগ্রত হইত । কিন্তু হইল না। মা আরো বলিলেন– নদীতে শিকল নামে এক ভয়ানক বস্তু থাকে। বেশি  ডুবাইলে সেই শিকল নিমেষেই টানিয়া লইয়া যায়। নিজেকে বড্ড ভালবাসিয়া সেই  শিকলের ভয়ে আর নদীতে নামিবার সাহস করি নাই । নিজের বেলা বাড়িবার সঙ্গে সঙ্গে বসন্তকালে অষ্টমীর প্রত্যূষে জলে নামিবার জো আর হইয়া উঠে নাই, পূণ্যিও লাভ করিতে পারি নাই। রবিঠাকুর মশাই-এর  তাঁর ছেলেবেলার চানদৃশ্য দেখিবার বর্ণনা বই-এর পাতায় পড়িয়া বেশ মজা পাইয়াছিলাম। পুকুরের ঘাটে সম্মিলিত স্নানাধারে নারী-পুরুষ, জাত-পাত, শিশু-বৃদ্ধও দলমত নির্বিশেষে স্নানপর্ব সকলের মনেই বেশ রোমাঞ্চ জাগাইয়া তুলে । জাতীয়তাবোধ, সম্প্রীতি ও প্রেম গড়িয়া উঠে পুকুরের পাড়,ঝিলের কিনারা, নদীর ঘাট আর সাগরের সৈকতেই। মনে পড়ে চন্ডিদাস আর রজকীনির সেই নিকশিত প্রেমের দৃশ্য ? জলের ঘাটেই তো এরা জীবনের গানে সুর লাগাইয়াছিলেন । কৃষ্ণের প্রেমের হাবুডুবু তো সেই পুকুরের ঘাটেই।গোকুলে সখি পরিবৃতা রাধা যখন নাইতে ব্যস্ত ব্যাটা কানাইয়া তখন বাঁশি বাজাইয়া কদম্বের মগডালে । স্নানের ঘাটে চোখাচোখি, সাবান ডলিতে ডলিতে খুনসুঁটি, ঘাটের সিঁড়ি হইতে লাফাইয়া জলে ঝাঁপাইয়া পড়া, ভিজা কাপড়ে জবুথবু হইয়া দ্রুতলয়ে উঠানের উপর পদচিহ্ণ আকিঁয়া পাশের বাড়ির বৌদির চলে যাওয়ার দৃশ্য কিম্বা ডুব সাতাঁর মারিয়া ঐপাড়ে উঠিয়া ব্যাটাগিরি দেখাইবার দিন এখন প্রায় বিদায় লইতেছে ।

       আমার শ্যালিকা আমাকে মাঝে মাঝেই নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করিয়া মজা উপভোগ করিয়া থাকে। যেমন একদিন প্রশ্ন ঝারিল – আচ্ছা জামাইবাবু, কন তো নজরুল কে? আমি বিপাকে পড়িয়া তাহাকে সোজা ভাষায় বলিলাম নজরুল হইতেছেন এগরুলের ছোট ভাই । কারণ এখন নজরুলের চাইতে এগরুল বেশি জনপ্রিয়। গত হপ্তায় আবার শ্যালিকার প্রশ্ন –জাইম্বু, কন তো দেশে এখন সম্প্রীতির অভাব ক্যান ? মানুষ এতো অসহিষ্ণু হইয়া হাবুডুবু খাইতেছে ক্যান? নাকের চশমাটা টেবিলে রাখিয়া শ্যালিকার মুখের উপর অতীব সহজ ভাষায় জবাব দিলাম – যৌথ স্নানের অভাব । পুকুরের ঘাটও নাই দল বাধিঁয়া স্নানও নাই। ফলে প্রেম নাই। পুকুরে কেউ হাবুডুবূ খাইলেও এখন তাহাকে পাড়ে টানিয়া তুলিবার লোক নাই।কারণ সাঁতার জানে না ।  ফলে সম্প্রীতির ঘাটতি দেখা  দিয়াছে । শ্যালিকা বলিলেন – জাইম্বু,ক্যারি অন। আমিও চালাইয়া খেলিতে শুরু করিলাম । একটানে তাহাকে সবিস্তারে বলিলাম – এখন সব্বাই চান করে স্নানঘরে। আরশিতে নিজেকে দেখিতে দেখিতে সাবানের ফেনায় স্বপ্ন আকেঁ। শুধু নিজেকে লইয়াই ভাবিতে ভাবিতে স্নানশিল্প সমাধা করিয়া থাকে । মাথার উপর লস্যির ফেনার মতো হিসহিস করিয়া চিনচিনে ধারা শরীরকে ভিজাইয়া দেয়। টিভিতে সাবানের বিজ্ঞাপনের মডেল নায়ক নায়িকার মতো নিজেকে মনে হয়। প্রতিদিন একই দৃশ্য । কোন রোমান্স নাই । তাই না ? চল এইবার সাগর স্নানে যাই । শ্যালিকা মাথা নাড়িল । মনে হইল, আমার জবাব শুনিয়া সে পুলকিত হইয়াছে ।

      আমি চলিলাম সাগর দরশনে ।দেখিলাম এক অদ্ভুত গণস্নান,যৌথ হাবুডুবু। সে অবশ্য কোন তিথি দিনক্ষণ নহে । বসন্তকালে অষ্টমীর প্রত্যূষও নয়, এমন কী কোন কুম্ভস্নানও নয় । তর্পন তো নয়ই, শুধুই অর্পণ । সকল জাতধর্ম মিশিয়া গিয়াছে ওই সাগরের জলে । লহরী আসিয়া ভাসাইয়া দিয়াছে ধনী-অভাগার একখন্ড কাপড়কে । আমি দেখিলাম সাগরের কোন কৃপণতা নাই । সাঁতার না জানিলেও সকলেই ভাসিতেছে । কী আশ্চর্য যৌথ স্নানশিল্প ! সেলফির পর সেলফি। উদ্দাম ছেলেবুড়ো । ঢেউ আসিয়ে বয়সকে ভাঙ্গিয়া দিয়াছে । বদ্ধ স্নানঘর থেকে বাইরে আসিয়া মানুষ যেন বলিতে চাহিতেছেন  – আমাদের পাড়ায় পাড়ায় একটা সাগর আনিয়া দাও, আমরা একসাথে চান করিব ।ঢেউ এর দোলায় দোলায় আমরা পানকৌড়ির মতো ভাসিয়া যাইব । হরিদ্বারে কুম্ভস্নান, পুরী, দীঘা, মন্দারমণির সমুদ্রের নোনা বালি মাখা জলে অগণিত দেশবাসীর গণস্নান দেখিয়া এই অধমের ইহাই  মনে হইল যে - অসহায় জাতি ডুবিয়া মরিবে না । সন্তরণ না জানিলেও দেশবাসী একসাথে ভাসিতে জানে ।জীবনের গান গাইতে জানে ।  উপরের ছবিটি কী সেই কথাই বলে না ?

ছবি ঃ ঋষভ গান্ধার     

 


মাটির দুর্গার অন্তরালে জ্যান্ত দুর্গা কাঁদে

চোখের জল মুছে শক্তিরূপিনী হও । জ্যান্ত দুর্গাদের রুখে দাঁড়াতে হবে নিজের সন্তান টিকে প্রকৃত শিক্ষা দিয়ে মানুষ করার জন্য । যে ছেলের জন্য মায়ের প্রতি নিয়ত অবমাননা তার জন্য মায়ের দিকে আঙুল উঠে । জ্যান্ত দুর্গারা অন্তরের শক্তি নিয়ে রুখে না দাঁড়ালে সমাজ কি সুস্থ থাকবে ? 

সপ্তাহের সাতকাহন - শ্যালিকার নগর দর্শণ

এখন থেকে প্রতি সপ্তাহের সোমবার সপ্তাহের সাতকাহন। লিখছেন রাজ্যের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও লেখক দেবাশিস লোধ। এই হপ্তাহের সাতকাহনে শ্যালিকার নগর দর্শণ

সপ্তাহের সাতকাহন - একটি পোড়া কাহিনি

এখন থেকে প্রতি সপ্তাহের সোমবার সপ্তাহের সাতকাহন। লিখছেন রাজ্যের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও লেখক দেবাশিস লোধ। এই হপ্তাহের সাতকাহনে একটি পোড়া কাহিনি

সপ্তাহের সাতকাহন - দে মা আমায় তবিলদারী

এখন থেকে প্রতি সপ্তাহের সোমবার সপ্তাহের সাতকাহন। লিখছেন রাজ্যের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও লেখক দেবাশিস লোধ। উৎসব মরশুমে tripuraindia.com এর বিশেষ উপহার। এই হপ্তাহের সাতকাহনে দে মা আমায় তবিলদারী

সপ্তাহের সাতকাহন - এসো মা লক্ষ্মী

এখন থেকে প্রতি সপ্তাহের সোমবার সপ্তাহের সাতকাহন। লিখছেন রাজ্যের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও লেখক দেবাশিস লোধ। উৎসব মরশুমে tripuraindia.com এর বিশেষ উপহার। এই হপ্তাহের সাতকাহনে এসো মা লক্ষ্মী

সপ্তাহের সাতকাহন - আগরতলার দুর্গাপুজো ২

এখন থেকে প্রতি সপ্তাহের সোমবার সপ্তাহের সাতকাহন। লিখছেন রাজ্যের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও লেখক দেবাশিস লোধ। উৎসব মরশুমে tripuraindia.com এর বিশেষ উপহার। এই হপ্তাহের সাতকাহনে আগরতলার দুর্গাপুজো/২

সপ্তাহের সাতকাহন - আগরতলার দুর্গাপুজো ১

এখন থেকে প্রতি সপ্তাহের সোমবার সপ্তাহের সাতকাহন। লিখবেন রাজ্যের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও লেখক দেবাশিস লোধ। উৎসব মরশুমে tripuraindia.com এর বিশেষ উপহার। প্রথম পর্বের এই হপ্তাহের সাতকাহনে আগরতলার দুর্গাপুজো/১